“বিজয়ের নামে বন্দুকের শক্তিতে যুদ্ধ পুরুষদের নারী ধর্ষেণের এক মৌন লাইসেন্স প্রদান করে”-
(সুসান ব্রাউনিমিলার- অ্যাগেইন্ট আওয়ার উইল)
“উইমেন আন্ডার সিজ” নামক যুক্তরাষ্ট ভিত্তিক মহিলা মিডিয়া সেন্টার তদন্ত করে জেনেছিল কীভাবে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতাকে যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। কিশোরীদের কলাগাছের সাথে বেঁধে একের পর এক ধর্ষন করা হত এবং কয়েক সপ্তাহ পর সেই গাছেই রশি দিয়ে গলায় বেঁধে কিংবা কুপিয়ে হত্যা করা হত।
একাত্তর সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলার চল্লিশ হাজার নারী ও মেয়েদের দীর্ঘ নয়মাস পর্যন্ত ধর্ষণ করে আসছিল। এই ভয়াবহ নির্যাতন ও ধর্ষণ শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দ্বারা হয়েছিল তা কিন্তু নয় বরং তাদের অনুসরণ করে কিছু সুবিধাবাদী বাঙ্গালীরাও তাদের দ্বিতীয় দফা ধর্ষন করে।
লেখক নিজ কেলি ওয়ারস অ্যাগেইন্ট উইমেন- বলেন “প্রকৃত ধর্ষনকে অনুসরণ করে দ্বিতীয় দফা ধর্ষণ করা হয়।”
ধর্ষিত নারীদের তাদের সম্প্রদায় এমনকি তাদের পরিবার ও তাদেরকে একঘরে করে রাখে যার ফলে তারা জাতিচ্যুত হয়। একাত্তরের যুদ্ধে নারী ধর্ষণ আধুনিক ইতিহাসে এক নজিরবিহীন অপরাধ হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। অ্যাগেইন্স্ট আওয়ার উইল এর লেখক সুসান ব্রাউনমিলার বলেন, “ধর্ষণগুলো খুব পরিব্যাপক ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানীদের পরিকল্পনা অনুযায়ী এটি ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা নতুন এক জাতি তৈরি করতে বা বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদকে অবলুপ্ত করতে।” ১৯৯৫ সালের বসনিয়া যুদ্ধের পর ধর্ষণ একটি যুদ্ধপরাধ হিসেবে স্বীকৃত হয়। এই অপরাধের শাস্তি কারাদন্ত বা মৃত্যুদন্ড হলেও ধর্ষণ এখনও যুদ্ধের এক সাধারণ কান্ড।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অনুসারে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “নারীদের মৃতদেহ ভূখন্ডের সংঘাতের এক অংশ হয়ে আছে।” এবং এ প্রতিবেদন আরও বলা হয়েছে, “ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়ন শুধু যুদ্ধের একটি উপজাত দ্রব্যই ছিল না বরং এটা ছিল সামরিক বাহীনির একটি ইচ্ছাকৃত কৌশল।” এ্যামনেস্টিয় সময়ে শহরগুলোতে এই নির্যাতন দন্ধ সবসময়ই ঘটতো। যেমন:- সিরিয়া, ইরাক, কঙ্গো, সোমালিয়া ও মিয়ানমার, ধর্ষনকে যে একটি যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত করা হত তা পুরোনো ইতিহাসেও ফিরে গেলে পাওয়া যায়।
পূর্বে গমনকারী সৈনিকদের জন্য এটা একটি সুবিধাবাদী নির্যাতন ছিল যেটাকে তখনকার সময়ে “Hit and Run” নামে অ্যাখ্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু আধুনিক সময়ে ধর্ষণকে সংঘাতের পরিকল্পিত কৌশল হিসেবে গণ্য করা হয়। তাহলে এর অর্থ দাড়ায় যে ধর্ষন এখন জাতি নির্মূলের দ্বন্ধে ব্যবহার করা একটি পরিকল্পিত আয়োজনের সামরিক অস্ত্র। বসনিয়ার উপর যেমন এটি ব্যবহার করা হয়েছিল ঠিক তেমনই মিয়ানমার এবং সিরিয়ার উপর এখন ব্যবহার করা হচ্ছে ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রন লাভের লক্ষ্যে। একজন পুরুষ তার উচ্চতর শক্তি বা পুরুষত্ব পরীক্ষার জন্য একজন মেয়ে বা নারীকে জোরপূর্বক তাকে মৌলিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ধর্ষণ কিংবা গনধর্ষণ ছাড়া আর কি কোন ভাল উপায় থাকতে পারে?;
লেখক সুসান ব্রাউনমিলার লিখেছেন, “পুরুষ কর্তৃক বল প্রয়োগ করে নারীর শরীরে হস্তক্ষেপ, নারীর শারীরিক প্রতিবাদ এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও এটা পুরুষের কাছে একটি অর্জন এবং বিজয়ের লক্ষ্য হয়ে ওঠে।” এক সম্প্রদায় যদি আরেক সম্প্রদায়কে নিয়ন্ত্রনে আনতে চায় তবে তার প্রধান অস্ত্র হয়ে ওঠে ধর্ষণ এবং এটা সেই সম্প্রদায়ে নারী তৃপ্তিও বটে, আর এই প্রধান অস্ত্র ব্যবহার করে শত্রু নিপাতন চলতে থাকে। বসনিয়ায় ধর্ষণ ব্যবহার করা হয়েছিল যাতে ঐ দেশের নারীদের গর্ভে সার্বিয়ান শিশু জন্ম নেয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও এ ঘটনা ঘটেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীরা বাঙ্গালী মেয়ে ও নারী ধর্ষণ করেছিলো যাতে তারা তাদের বংশ বিস্তার বাংলায় ঘটাতে পারে, যার ব্যাখ্যা করেছিল কিনা “এতে তারা পাঞ্জাবী বাচ্চা পাবে”।
১৯৯২-১৯৯৫ সালে বসনিয়ায় ধর্ষণকে যেভাবে সামরিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল ঠিক সেই ভাবে একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলার চল্লিশ হাজার মা বোনদের উপর সেই একই ভাবে প্রয়োগ করেছিল, পূর্ব শতাব্দীগুলোর যুদ্ধে ও এত পরিমাণ ধর্ষণ হয়েছে যা গণনাতীত।
“বীরাঙ্গনা” একাত্তর সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়িকারা, Women under siege অনুসারে ৮ বছর থেকে শুরু করে ৭৫ বছর বয়সী মহিলাদের অপহরণ করে সামরিক ধর্ষণ ক্যাম্পে ধর্ষণের তুচ্ছ বস্তু হিসেবে বন্ধি করে রাখত, এছাড়াও অভিযোগ করা হয়েছিল পুরুষরা ক্যাম্পে এইসব অশ্লীল ভিডিও ধারণ করে রাখত। লেখক ব্রাউনমিরার নির্ভরযোগ্য একজন ভারতীয় লেখকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা এক তথ্যের ভিত্তিতে বলেন যে, “এটা সুস্পষ্ট যে এই ভিডিও গুলোই পুরুষদের ধর্ষণ করতে প্রয়াস জাগাত।”
নারী ও মেয়েদের এই গনধর্ষণকে অনুসরণ করেই পরে গনহত্যা সংঘটিত হত এবং তা গণকবরে পরিণত করা হত। যাতে তাদের শরীরের সাথে সাথে কাটা স্তন সহ শরীরের কাটা অন্যান্য অঙ্গ ও পাওয়া যেত।যে মুসলিম পুরুষ নিজের মায়ের উপাসনা করে, মায়ের কোলকে পবিত্র মনে করে এবং তাদের পায়ের নিচে বেহেস্ত এই কথাগুলো বিশ্বাস করে, সে মুসলিম পুরুষগণ অন্যের মা-মেয়ে কিংবা মহিলাদের প্রতি এই ধারণা কিভাবে রাখতে পারলো না।
অনেক প্রত্যক্ষদর্শীদের বলতে শুনা যায় ট্রাকভর্তি পাঞ্জাবী সৈন্যদের আতঙ্ক ছড়ানোর ভয়ঙ্কর কাহিনী এবং তাদের ভাড়াটে সহকারী যাদের আমরা রাজাকার হিসেবে চিনি তাদের করা সহযোগীতার কথা। যারা মুক্তিযোদ্ধা নিধনের পাশাপাশি রাতে অসংখ্য নারী ও মেয়েদের ধর্ষণ করতে সহযোগীতা করত। কিছু সংখ্যক ধর্ষণ সংঘটিত হত মা-বাবা, স্বামী এবং অন্যান্য সদস্যদের সামনে; এবং পরিবারের সদস্যদের বাধ্য করা হত এইসব হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখার জন্য; এবং ধর্ষিণের শিকারগ্রস্থদের অধিকাংশই ছিলো নিরপরাধ কিশোরী, বালিকারা ও অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্তদের জড়ো করে পাঞ্জাবী সৈন্যরা বিভিন্ন স্থানের ধর্ষণ ক্যাম্পে পাঠাতো, তাদের সঙ্গে রাজাকাররাও জড়িত ছিল- সেই সাথে ছিলো কিছু উৎসুক ধর্ষক যাদের মধ্যে অনেকে এখনও অবাধে বাংলাদেশে বসবাস করছেন। এভাবে অনেক গল্প আছে কিন্তু তার মধ্যে একটি গল্প জানা যায় ঢাকার ইন্টারন্যাশনাল এইডেড এ্যাকশন ক্লিনিক থেকে। (প্রথমে Dacca এবং পরে Dhaka- তে নামকরণ করা হয়।)
মাত্র তেরো বছর বয়সী এক মেয়েকে বারো জন পাঞ্জাবী সৈন্য মিলে গণধর্ষণ করে এবং তার চোখের সামনেই তার বাবা-মা এবং দুই বোন ও এক ভাইকে হত্যা করা হয়।
আরও এক তেরো বছর বয়সী মেয়েকে বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়ার সময় পাকিস্তানী সৈন্যরা অপহরণ করে যার সাথে আরও চার মেয়েও ছিল। তাদের সবাইকে ঢাকার মোহাম্মদপুরের সামরিক ধর্ষণ ক্যাম্পে রাখা হয় এবং সেখানে তাদের যুদ্ধের শেষ সময় পর্যন্ত রাখা হয় যার সময় বাধাঁ হয়েছিল ছয় মাস পর্যন্ত। ঐ মেয়েকে সামলাতে এবং আর্তচিৎকার থেকে বিরত রাখতে কন্ঠরোধ করা হয়েছিল এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে দিনে দুই জন করে পুরুষ ধর্ষণ করত। আর বাকীদের দশজনের মতো পুরুষ ধর্ষণ করত।
অন্যান্য সাক্ষীদের থেকে জানা যায় যে, প্রতি রাতে আশিটিরও বেশি নিপীড়ন হত এবং নিরপরাধ কিশোরীদের অকল্পনীয়, বেদনাদায়ক শারীরিক নির্যাতন হত। এই ভাবে নারী এবং মেয়েদের গনধর্ষণ, অত্যাচার, গর্ভপাত, বিকৃত বা অঙ্গাহানি এবং খুন করা হয়েছিল। বস্তুত বাংলাদেশের নারী এবং মেয়েদের উপর ১৯৭১ সালের গণহত্যা অন্য যেকোন সংঘর্ষের ধর্ষণের মাথাপিছু সর্বোচ্চ হারের অন্যতম মনে করা হয়।
যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ অবজারভার রিপোর্ট জানিয়েছিল যে, ৪০,০০০-৪৩,০০০ নারীরা পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে ২০,০০০ নারী অন্তঃসত্ত্বা ছিল। এটি আরও জানায় যে, ১৭,০০০ নারীদের আদিম পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে গর্ভ নষ্ট করা হয়েছিল যা ঢাকাতে যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান বসিয়ে ছিল সেটির দ্বারা হয়েছিল । পরিশেষে ৩০,০০০ এরও বেশি নারীরা তাদের সাথে ঘটা ঘটনাগুলো সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিল।
পশ্চিম পাকিস্তানের ‘পাঞ্জাবী সেনাবাহিনী কর্তৃক নিরপরাধ নারী এবং মেয়েদের উপর নির্যাতন ও অপব্যবহারকে অনুসরণ করে নব প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রক্ষনশীল সমাজের কিছু নাম ধারী মুসলিমও তাদের উপর আবারও নির্যাতন শুরু করেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর এ ধরণের বর্বরতা নয় মাস পর্যন্ত স্থায়ী ছিল এবং তা বাংলাকে এক নরকে পরিণত করেছিল। যুদ্ধের পর নির্যাতিত ধর্ষিত এবং অন্তঃসত্ত্বা নারী মেয়েদের প্রতি বাঙ্গালী মানুষদের বিশেষ করে তাদের বাবা, ভাই, স্বামী এদের প্রতিক্রিয়া আরও ভয়ঙ্কর ছিলো।
রেভারেন্ড কেনটারো বিউমা (ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অফ চার্চেস এর ত্রাণ সচিব) যিনি দু-সপ্তাহের জন্য বাংলায় এসেছিলেন এবং পরে বর্ণীত হয় যে হাজারো ধর্ষিত নারী এবং মেয়েরা গর্ভবতী হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন যে, “ঐতিহ্য মতে কোন মুসলিম স্বামী অন্য পুরুষ দ্বারা স্পর্শ করা স্ত্রীকে মেনে নেয় না। যদিও জোর করে ধর্ষণ করা হয়েছে।”
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধের পর (১৬ই ডিসেম্বর) পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য কর্তৃক ধর্ষণের শিকারগ্রস্থ দুই লক্ষ নারীদের “বীরাঙ্গনা” উপাধিতে ভূষিত করেন।
“বীরাঙ্গনা” শব্দটি ভাষাগত ভাবে ‘বারাঙ্গনা’র” মতো উচ্চারিত হয় যার অর্থ পতিতা, এর কারণে এ উপাধিটিকে অপব্যবহার করে অনেকে তাদেরকে অপমানের জন্য ব্যবহার করত, যার ফলে নারীরা এই সদুদ্দেশ্যে প্রনোদিত শিরোনামটিকে ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। কারণ এটি কেবল বিদ্যমান নির্যাতন ও কলঙ্ক বৃদ্ধি করেই চলছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের স্বামী এবং অন্যান্য পুরুষদের সর্বাত্মক দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে তাদের “বীরাঙ্গনা” বা যুদ্ধ বীর নারী” হিসেবে গন্য করা উচিত এবং তিনি শিকারগ্রস্থদের প্রতি পুরুষদের সহানুভূতিশীল হওয়ার ও তাদের সমাজে আবার একত্রিত করার লক্ষ্যে বিয়ে করানোর প্রচারণা শুরু করেন এবং তাদের বর্তমান স্বামীদেরকে তাদের ফিরিয়ে নেওয়ারও আহ্বান জানান।
যাই হোক, জাতির জনকের এই সদুদ্দেশ্যকৃত অভিযান বেশ সফল হয়নি। দুর্ভাগ্যবশত অবিবাহিত ধর্ষণের শিকারদের জন্য মাত্র ১০,০০০ লোক এগিয়ে আসে এবং কেবল মাত্র লোভের ভিত্তিতেই তারা নারীদের সাথে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়। তারা সরকারের কাছে সুদৃশ্য যৌতুকের দাবি জানায় যেটা তাদের (বীরাঙ্গনাদের) তৃতীয়বারের মতো কলুষিত করে। তাদের এই যৌতুক চাহিদাগুলোর মধ্যে সর্বশেষ লাল রং এর জাপানি কার উল্লেখিত।
মাত্র মুষ্টিমেয় বর্তমান স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের ফিরিয়ে নিতে এগিয়ে আসে যেখানে অন্যরা তাদের বউদের সম্পূর্নরূপে কলুষিত এবং তাদের কোনো মূল্যেই নেই মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে বীরাঙ্গনাদের নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার চেয়ে মেরে ফেলাই শ্রেয় মনে করেছিলেন এবং এ অনুভূতি খুবই দৃত্বছিলো।
লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক গর্ভপাত গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ডাঃ জ্যোফ্রে ডেভিস যিনি বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে অনেক কাজ করে অতিবাহিত করেছেন তার কাছ থেকে জানা যায় যে, “অগনিত আত্মহত্যা এবং শিশু হত্যা সম্পর্কে তিনি অবগত” তিনি আরও জানান যে, ইদুঁর মারার বিষ খেয়ে এবং ডুবে মরা সুস্পষ্ট উপলব্ধ ছিল।
ডেভিস আরও জানান যে, ধর্ষিতারা তাদের স্বামী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্য দ্বারা নিকৃষ্ট দূব্যবহারের শিকার হতো। লেখক ব্রাউনমিলার এক নারীগোষ্ঠী থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন যা তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশ করেন, এবং যাতে বলা হয় “ইহা অকল্পনীয় যে নিরাপধ স্ত্রীদের সর্বস্থ এ যুদ্ধে ধ্বংস হয়েছে এবং যা একটু বাকি ছিল তা ধ্বংস হচ্ছে তাদের স্বামীদের দ্বারা।” ব্রাউন মিলার আরও বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামের সময় তাদের নিজেদের নারীদের প্রতি অবিচারের জন্য পুরুষদের অন্ধত্ব স্পষ্টভাবে দায়ী”।
ধর্ষণের শিকারগ্রস্থরা উভয়পক্ষে নির্যাতিত হয়েছিল বিশেষ করে বাঙ্গালী লোক নিজেরাই নিজেদের নির্যাতন করেছে।
সালেহা বেগমের এক মর্মভেদী গল্প অন্তর্ভূক্ত করা যায় যাকে ধর্ষণের পর গুলি করে এক মৃতদেহের স্থুপে ফেলে দেওয়া হয় মেরে ফেলার জন্য। তিনি এক প্রতিবাদককে জানান, “সেই সময়ে তিনি দু-হাত তুলে মৃত্যুকে কামনা করছিলেন আকাশের দিকে তাকিয়ে, সেই সময়ের কথা তিনি আজও ভুলতে পারেন নি”। কিন্তু অবশেষে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করেন। তিনি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় যখন বাড়ি ফিরে আসেন তখন স্থানীয়রা তাকে “খানকি” বলে গালিগালাজ করতে থাকে, ধর্ষণের ফলে তার একটি ছেলের জন্ম হয় যে কিনা মাত্র চারদিন বেঁচে ছিল।
স্থানীয় লোকদের অপমানের হাত তেকে বাঁচার জন্য তিনি তার মাকে ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে তিনি কাজের লোক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন অবশেষে মনের মত একজনকে খুঁজে পান যার সাথে পরবর্তীতে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি সত্যটা গোপন রাখেন যদি আবার দেখা স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় এই ভয়ে। মিথ্যের আশ্রয় নেন যুদ্ধ বিধবা হিসেবে পরিচয় দেন। প্রায় পনেরো বছর পর যখন তার স্বামী আসল সত্যটা জানতে পেরেছিলো তখন সালেহা বেগমের সংসার ভাঙ্গতে বসে। শেষমেষ তার কিশোরী মেয়ের দিকে তাকিয়ে তার স্বামী কোন পদক্ষেপ নেন নি। সালেহা বেগমের গল্পটি বাংলার হাজার হাজার ধর্ষণের শিকারগ্রস্থ নারীদের গল্পের একটি। ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং তারা অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল তা থেকে বেঁচে ফেরার জন্য ও নির্যাতিত হতে হয়েছে, যদিও এরকম নারীরা আজও বেঁচে আছেন। কিন্তু তারা সবার সামনে আসতে চান না হাসি-ঠাট্টা ও বিদ্রুপের ভয়ে। বাংলাদেশ যদিও একটি স্বাধীন দেশ তবুও সালেহা বেগমের মতো বীরাঙ্গনাদের পতিতার নাম নিয়ে অবহেলিত হয়ে থাকতে হবে?কেন কোন মর্যাদার পরিচয় নিয়ে নয়?
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪০ বছর পর ২০১১ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতাধীন “যুদ্ধপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে এবং তার দ্বারা অনেক যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায়ও কার্যকর করা হয়েছে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এর প্রক্রিয়া নিয়ে নিন্দা করছে এবং বলা হচ্ছে এটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার (দ্যা মাদার অফ হিউম্যানিটি) প্রতিহিংসা।
তবে এই রকম বহুল প্রতিক্ষীত ন্যায়বিচারের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নিকৃষ্ট নিপীড়ন ও নির্যাতন সয়ে যাওয়া নারীদের জন্যও না হয় ন্যায় বিচার জরুরী।
বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল সব যুদ্ধাপরাধীদের তাদের প্রাপ্য সাজা দিতে পারে নি শুধু একটি মাত্র কারণে পালিয়ে যাওয়া এবং অন্যান্য দেশের নাগরিক (যেমন: যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র) হওয়ার দরুন।
সে সময় গণহত্যা এবং সবরকমের অত্যাচার সবার দৃষ্টিগোচর ও বিতর্কিত হলেও বিশ্বের আঙ্গিনায় বীরাঙ্গনারা কোন মনোযোগ আকর্ষন করতে পারে নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মাতা ক্ষমতাবান দেশগুলো কেন এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেনি তা এখনও প্রশ্নই থেকে যায়।
শুধুমাত্র ভারতের ইন্দিরা গান্ধী পূর্বপাকিস্তানের অর্থাৎ বাঙ্গালীদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন এবং তার দেশের সৈন্যও প্রেরণ করেছিলেন। বিবিসির এক প্রতিবেদক ভারতকে শান্ত থাকতে এবং যুদ্ধে কোনো অবদান না রাখার জন্য সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু তার প্রতিউত্তরে ইন্দিরা গান্ধীর জবাব ছিল, “শান্ত থাকা মানে গণহত্যাকে সমর্থন করা। যখন হিটলার তান্ডব চালাচ্ছিল তখন আপনারা কেন বললেন না চলো সবাই শান্ত থাকি, চুপ থাকি, নিরবে সব সমর্থন করি এবং ইহুদীরা মারা যাক। এটা কখনোই ঘটতো না যদি বিশ্ব সম্প্রদায় প্রথমেই মনোযোগ আকর্ষণের সময় জেগে উঠতো।”
বাংলাদেশের মানুষ যারা ধর্ষিতা মহিলাদের একঘরে ও বিদ্রুপ করে আসছে তাদের লজ্জা পাওয়া উচিত। কারণ এই বীরাঙ্গনাদের চরম ত্যাগের জন্যই আমরা প্রতিবছর তথাকথিত স্বাধীনতা উদযাপন করে আসছি। এই নারীদের সবসময় স্মরণে রেখে শ্রদ্ধা করা উচিত এবং তাদের বীরাঙ্গনা হিসেবে পরিচিতি ও প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার দায়িত্ব ও কর্তব্য আমাদের’ই।
By Aklima Bibi – Human Rights Lawyer & Journalist
Photos: credit Google search
Please report any errors to : info@aklimabibi.com